ঐতিহ্যের মধুপুর ক্লাবের ৮৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী

- আপডেট সময় : ০৭:৫৫:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫১ বার পড়া হয়েছে

সাহিত্য সংস্কৃতি বিনোদন ঐশ্বর্য পরিপূর্ণ এক সময়কার সমৃদ্ধ জনপদের নাম টাঙ্গাইলের মধুপুর। লাঠিখেলা,পালা গান, ধুয়া, জারি গান, বাদ্য, বাঁশি বাজিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। প্রতি সন্ধ্যায় বিভিন্ন গ্রামীণ উঠানের অনুষ্ঠানে বাড়ির বৌঝিয়েরা ঘোমটার আড়ালে এসব গানসহ বিভিন্ন সংস্কৃতির পর্বানুষ্ঠানের আয়োজন উপভোগ করতেন। যাত্রা ও নাটকের ক্ষেত্রে নামডাক ছিল এ জনপদের। হা-ডু ডু, কাবাডি, ফুটবলসহ নানা খেলা তো ছিলই। আর এসব চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপের নাম মধুপুর ক্লাব। সাড়ে ৮ দশক আগে জন্ম নেয়া ক্লাবটির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ঘিরে বর্ণাঢ্য আয়োজনে আজ শনিবার রাত ১০ টা পর্যন্ত চলবে কর্মসূচি। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠা ক্লাবটি এবার ৮৬ তম বছর পার করছে। পবিত্র রমজানে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনটি থাকায় এবার কর্মসূচি এগিয়ে আনা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামায় দুনিয়া জুড়ে আতঙ্ক। ব্রিটিশের শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা উপমেহাদেশ জুড়ে। মেঘমুক্ত প্রতিটি সুন্দর সকালের প্রত্যাশার সাথে যুগপৎ ছিল ব্রিটিশের শাসন থেকে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের। ঠিক ওই সময়ে টাঙ্গাইলের বন অধ্যুষিত মধুপুরে গড়ে উঠে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজকের মধুপুর রাণী ভবানী মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির উন্নতি ঘটাতে ওই নতুন বিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষক এ বন অধ্যুষিত জনপদে গড়ে তুলেন নাট্য আন্দোলন। শীতকালে তারা নাটক মঞ্চস্থ করতে মহড়া দিয়ে দিয়ে নাটককে মঞ্চে উপস্থাপনের উপযোগী করে তুলেন। নারী বর্জিত নাটক হলেও পুরুষকে নারী সাজিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হতো। সমাজের নানা চিত্র নাটকে তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করার ওই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল। ৮৫ বছর আগে এমন একটি নাটক মহড়ার প্রাক্কাকালে নাট্য আন্দোলনসহ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। বাংলা ১৩৪৫ সালের ২২ শে মাঘ মধুপুরের প্রফুল্ল কুমার চৌধুরীর কাঁচারি ঘওে নাটকের মহড়া শেষে এই মধুপুর ক্লাব গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। রাণী ভবানীর সহকারী শিক্ষক বঙ্কিম চন্দ্র চক্রবর্তী ও হেড পন্ডিত নরেন্দ্রনাথ ভৌমিকের সাথে এলাকার বিজ্ঞজন যতেœশ্বর লাল সিংহ,খগেন্দ্র নাথ চৌধুরী, সুধী রঞ্জন গুহ নিয়োগীসহ মদন গোপাল দেবোত্তর এস্টেটের সেবায়েতগেেণর প্রতিনিধি নিয়ে ক্লাবটি প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই দিন একটি কমিটিতে ক্লাবের কাঠামো দাঁড় করানো হয়। সভাপতি করা হয় তৎকালীন প্রাইভেট ডাক্তার খ্যাত সুনীল চন্দ্র ভট্টাচার্যকে। সহসভাপতির দায়িত্ব পান মদনগোপাল দেব এস্টেটের জমানবিশ মাখন লাল চক্রবর্তী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় যজ্ঞেশ^র রায় সিংহকে। সহ সাধারণ সম্পাদক হন সুধীরঞ্জন গুহ নিয়োগী। ম্যানেজার পদে খগেন্দ্র নাথ চৌধুরী দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এছাড়া ৬ নং মধুপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মীর মুনছের আলী, বঙ্কিম চন্দ্র চক্রবর্তী, পূর্ণ চন্দ্র রায়, আকালিয়া দাস কে সদস্য পদে রেখে ৯ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। তাঁদের নেতৃত্বে পরবর্তীতে রাণী হেমন্ত কুমারী দেবী প্রতিষ্ঠিত দেবোত্তর এস্টেটের বর্তমান জমিতে ক্লাবি ভবনটি দাাঁড়িয়ে আছে। শুরু থেকে সংস্কৃতি, বিনোদন ও ক্রীড়ার বাতিঘর হিসেবে মধুপুর ক্লাব পরিচিত হয়ে উঠে। ক্লাবের পাঠাগারকে করে তোলা হয় সমৃদ্ধ। এখান থেকে বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলতো। আয়োজন হতো নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। অল্পকথায় অনুপ্রেরণা ও আত্মশুদ্ধির বাতিঘর হিসেবে যাত্রা করা এ ক্লাবটি মধুপুরকে আলো করে রাখতো। রীতি অনুযায়ী ক্লাবটির সভাপতি স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান। অর্থাৎ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এ পদ ছাড়া সব পদে নির্বাচন কওে ক্লাব সদস্যগণ দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
ক্লাবের অন্যতম সদস্য মধুপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র মাসুদ পারভেজ জানান, আমাদের স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক ও সশস্ত্র আন্দোলনের ফসল নয়, একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও ফসল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এই আন্দোলনের সূত্রপাত। তারও দেড় দশক আগে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম নিঃসন্দেহে আমাদের এ জনপদের মানুষের উন্নত চিন্তার পরিচায়ক ।তাই বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক এ প্রতিষ্ঠানের অবদান নেহাত কম নয়।
ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শী, ধর্মীয় বিশ্বাসীদের একটি ঐক্যমঞ্চের নাম মধুপুর ক্লাব । এই মধুপুর ক্লাব নিয়ে অনেক ইতিবাচক ঐতিহ্য থাকলেও বর্তমান নিয়ে পুরোনো অনেকের মধ্যে ক্ষোভ আছে। নাম প্রকাশে তাদের অনীহা। তাদের কথা হলো- আগের মতো সামাজিক দায়িত্ব পালনে মধুপুর ক্লাবের ভূমিকা চোখে পড়ে না। ক্লাব গঠনের লক্ষ্যে স্থির থাকতে হলে এবং প্রতিষ্ঠাতাদের চিন্তার প্রতি সম্মান থাকলে ক্লাবের ভূমিকা আগের অবস্থানে নেয়া জরুরী।
মধুপুর ক্লাবের ভূমিকা সামাজিক ও সেবামূলক কাজেও ছিল সমান তালে। ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক পৌর কাউন্সিলর আমজাদ হোসেন ভূঁইয়া এমনটি জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান,করোনা মহামারীতে অসহায় মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়েছে এ ক্লাব। সর্বশেষ জমকালো ক্রীড়া আয়োজন ছিল ২০১৪ সালে । ফুটবল লীগের ওই আয়োজনে জন সম্পৃক্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। সকল ধর্মের মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনের কেন্দ্র মধুপুর ক্লাব। আর এ ক্লাব ক্রীড়া, বিনোদন ও সংস্কৃতির বাতিঘর। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা-নির্বিশেষে বাঙালির সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটি যে এক ও অভিন্ন, সেই চেতনা সমুন্নত করতে মধুপুর ক্লাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও যাবে।